উত্তর দিনাজপুর জেলার ভূগোল।নামকরণ, ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু প্রভৃতি।

                        উত্তর দিনাজপুর

নামকরণ :-সুলতানি যুগে একমাত্র হিন্দু রাজা গণেশ 'দুনুজমর্দনদেব' উপাধি নিয়ে গৌড়েশ্বর হয়ে বসেন। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে এই নামটি ফরাসি ঐতিহাসিকদের উচ্চারণে হয়ে যায় 'দিনজ বা দানোজ। কালক্রমে ওই শব্দ থেকে জন্ম নেয় দিনাজপুর নামটি ।

স্বাধীনতার পূর্বে অবিভক্ত বঙ্গের মালদা ও বগুড়া, রাজশাহী ও রংপুর,পূর্ণিয়ার কিছু অংশ নিয়ে দিনাজপুর জেলা গড়ে উঠেছিল। 

1947 সালে দিনাজপুরকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল । ভারতের পশ্চিম অংশের নাম হল পশ্চিম দিনাজপুর। 1947 থেকে 1959 সালের মধ্যে এই জেলার ভৌগোলিক সীমা ও আয়তনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। 1948 সালে ও জেলার দুটি মহকুমা ছিল যথা রায়গঞ্জ ও বালুরঘাট । 1956 সালে বিহারের পূর্ণিয়া জেলার কিছু অংশ নিয়ে পশ্চিম দিনাজপুর জেলার উত্তর পশ্চিমের আয়তন বৃদ্ধি করা হয় এবং ইসলামপুর নামে একটি নতুন মহাকুমারও জন্ম হয় এইসঙ্গে।

1992 সালের পহেলা এপ্রিল তারিখে পশ্চিম দিনাজপুর জেলাকে দ্বিধাবিভক্ত করে দুটি জেলার সৃষ্টি করা হয়। এর একটি জেলার নাম উত্তর দিনাজপুর জেলা জলপাইগুড়ি বিভাগের অন্তর্গত  6টি জেলার মধ্যে এটি অন্যতম। 


উত্তর দিনাজপুর জেলার ভুগোলঃ-সীমানা,আয়তন,ভূমিরূপ, নদনদী প্রভৃতির পরিচয় 


সীমানা :-উত্তরে দার্জিলিং জেলা, পশ্চিমে বিহার দক্ষিণে মালদা জেলা ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা এবং পূর্ব উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশে অবস্থিত। 


আয়তন :-3110 বর্গকিমি । উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়ার কাছে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে কম চওড়া অংশ মাত্র 9 কিমি দেখা যায় তাই এই অংশকে বলা হয় "নেক অফ চিকেন"। 


ভৌগোলিক অবস্থান:-উত্তরে 26°35'15"উত্তর অক্ষাংশ এবং পশ্চিমে 87° 48'35"পূর্ব দ্রাঘিমায় অবস্থিত। 


ভূমিরূপ :-উত্তর দিনাজপুর জেলাটি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের সমভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত ।এর স্বাভাবিক ঢাল নদীপ্রবাহ বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। এই জেলার উত্তরাংশ "তাল" নামে পরিচিত ।এই জেলার দক্ষিণাংশ লাল রঙের, প্রাচীন পলিমাটি দ্বারা গঠিত , কিছুটা বন্ধুরতাযুক্ত ও মাঝে মাঝে টিলাযুক্ত-যা "বরেন্দ্রভূমি" নামে পরিচিত। 


নদ-নদী :-ভূমিরূপের স্বাভাবিক ঢাল অনুযায়ী নদী সমূহ উত্তর থেকে দক্ষিনে বিস্তৃত হয়েছে। এই জেলার প্রধান নদী মহানন্দা উত্তর সীমায় কিছুদূর প্রবাহিত হয়ে প্রবেশ করেছে। অতঃপর পুনরায় ইটাহারের মধ্য দিয়ে জেলায় প্রবেশ করেছে ।অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী নাগর ইসলামপুর মহাকুমার  মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ।এছাড়া কুলিক, সুই, সামার নদী উল্লেখযোগ্য ।নদী গুলির খাত সুনির্দিষ্ট। কিন্তু প্রায় খাত পরিবর্তন করে মাঝে মাঝে ছোট নদীতে পরিণত হয়। বর্ষাকালে নৌকা চলাচলের যোগ্য হলেও অধিকাংশ সময়ে শুষ্ক থাকায় নৌকা চলাচল বন্ধ থাকে ।এই জেলার উত্তরে ও মধ্যভাগে অসংখ্য ছোট-বড়ো জলাভূমি রয়েছে। বন্যার জল নদীর দুকূল ছাপিয়ে এলাকায় সঞ্চিত হয়ে এরকম জলাভূমি সৃষ্টি হয়েছে। 


জলবায়ু :-উত্তর দিনাজপুর জেলা উপক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে অবস্থিত,যা প্রকৃতিগতভাবে উষ্ণ ও আদ্র প্রকৃতির। গ্রীষ্মকালে উষ্ণ আবহাওয়া, মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও গড় আদ্রতা এই অঞ্চলের মূল বৈশিষ্ট্য । গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ উষ্ণতা থাকে 35 ডিগ্রি থেকে 38 ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শীতকালে 12 ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 1579 মিলিমিটার। এই জেলায় কালবৈশাখী ও আশ্বিনের ঝড় দেখা যায়। 


মৃত্তিকা :-উত্তর দিনাজপুর জেলায় তিন ধরনের মৃত্তিকা দেখা যায় ।যথা-(i) পুরনো পলিমাটি ( মাটির গভীরতা অধিক PH প্রশমিত থেকে সামান্য আম্লিক ধরনের ),(ii)পলিমাটি এবং(iii) নতুন পলিমাটি। 


স্বাভাবিক উদ্ভিদ:-এই জেলায় তরাই জঙ্গলের অবশিষ্ট রূপ এখনো বর্তমান ।এখানে প্রধানত শাল গাছ দেখা যায় ।এছাড়াও শিরীষ, জাম, নিম,অর্জুন বাঁশ-বেত ইত্যাদি গাছ লক্ষ্য করা যায়। এই জেলায় 7.48 শতাংশ অরণ্যাঞ্চল রয়েছে ।

উত্তর দিনাজপুর জেলার অর্থনৈতিক ভূগোলঃ- কৃষি,শিল্প, ব্যাঙ্ক প্রভৃতির পরিচয় 



কৃষি :-এই জেলায় উৎপাদিত প্রধান ফসল হলো- ধান, গম, ভুট্টা, আলু ,পাট,আদা, লঙ্কা, আখ ,চা, তৈলবীজ ইত্যাদি ।এছাড়াও এই জেলায় মূলত আম, কলা ,কাঁঠাল , পেয়ারা ,লেবু, পেঁপে ,আনারস, নারকেল ,লিচু প্রভৃতি ফলও উৎপাদিত হয়। 


শিল্প :-উত্তরদিনাজপুর একটি শিল্পে অউন্নত জেলা হলেও এখানে বিভিন্ন ধরনের শিল্প গড়ে উঠেছে।যেমন -

(ক)বড় ও মাঝারি শিল্প:-ডালখোলা ময়দা কল লিমিটেড, রায়গঞ্জ ,রায়মোহন টি এন্ড প্লান্টেশন লিমিটেড, চোপড়া ,পশ্চিম দিনাজপুর মিল লিমিটেড ,টুঙ্গীদীঘি রাইস মিল ইত্যাদি। ভবিষ্যতে কৃষিভিত্তিক ও হর্টিকালচার ভিত্তিক শিল্প গঠনের সুযোগ রয়েছে -আনারস, ধান থেকে নির্মিত তেল, খড়ের বোর্ড, পাটজাত দ্রব্যাদি। 


(খ)ক্ষুদ্র আকৃতির শিল্প :-হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের অনুসারী শিল্প রূপে প্লাস্টিক নির্মিত দ্রব্যাদি,মগ, বাক্স,বাড়ির আসবাব ও প্লাস্টিক মাদুর এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প চালকল, গমকল, তেলমিল, মসলা গুঁড়ো করার কল, বেকারি ইত্যাদি প্রধান।


(গ)গ্রামীন শিল্প:- বাঁশ ও বেতের কাজ, চানাচুর, বেকারি, পাটের দড়ি, ফটোফ্রেম, জুতো তৈরি, পিতলের বাসন, সাবাইঘাসের দড়ি,মোমবাতি, গোবর গ্যাস ,কাসুন্দি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। 


(ঘ)হস্তশিল্প :-টেরাকোটা (কালিয়াগঞ্জ, সুভাষগঞ্জ, রায়গঞ্জ,কুনোর)বাঁশ ও বেতের কাজ( রায়গঞ্জ সুভাষগঞ্জ ),পশমের কার্পেট (মালগাও, ইটাহার), মাদুর শিল্প (গোয়ালপোখর ।)


(ঙ) হস্তচালিত তাঁত :- মশারি ,কোর্স শাড়ি,ধোকরা, গামছা, পাটের ব্যাগ ,কার্পেট যন্ত্রচালিত সিল্ক থান (করণদিঘি )। 


ব্যাংক ও সমবায়:- ব্যাংকের সংখ্যা 81,ব্যাংক পিছু জনসংখ্যা হাজার 34, প্রাথমিক কৃষি সমবায় সংস্থা- 194। 


পরিবহন ব্যবস্থা:-(ক) সড়কপথ:- অন্যান্য জেলার তুলনায় উত্তর দিনাজপুর জেলায় সড়ক পথের দৈর্ঘ্য কম । 34 নং জাতীয় সড়ক  এই জেলার মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে 169 কিমি বিস্তৃত হয়েছে । এছাড়াও 10 নং রাজ্য সড়ক রায়গঞ্জ ও কালিয়াগঞ্জকে যুক্ত করেছে ।এই জেলায় জেলা সড়ক 135 কিমি, গ্রামীণ সড়ক- 287 কিমি। বর্তমানে রায়গঞ্জ টু ডালখোলা 4 লেনের কাজ চলছে। 


(খ)জলপথ:- এই জেলায় মহানন্দা, কুলিক, সুই নদীর উপর বিভিন্ন স্থানে নদী পারাপারের জন্য 38 টি ফেরি পরিষেবা, মূলত ইটাহার, হেমতাবাদ, রায়গঞ্জ ,চোপড়া , করণদিঘি প্রভৃতি ব্লকে রয়েছে। 


(গ)রেলপথ:- এই জেলায় কেবলমাত্র রায়গঞ্জ থেকে ইসলামপুর পর্যন্ত 96 কিমি দীর্ঘ রেলপথ আছে। 


জনসংখ্যা :-উত্তর দিনাজপুর জেলায় 3007134 জন। পুরুষ 51.58 শতাংশ। স্ত্রী 48.82 শতাংশ। 


উত্তর দিনাজপুর জেলার সাংস্কৃতিক ভূগোলের পরিচয় 


স্বাস্থ্য:- হাসপাতালের সংখ্যা 3 টি, পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র -গ্রামীণ সাতটি ,শহরে দুইটি ।


প্রশাসনিক বিভাগ:-মহুকুমা দুইটি- ইসলামপুর ও রায়গঞ্জ ।জেলা সদর রায়গঞ্জ ,গ্রাম পঞ্চায়েত 98 টি।পঞ্চায়েত সমিতি  9টি ,থানা দশটি, ব্লক 9টি, পৌরসভা চারটে( রায়গঞ্জ ,ইসলামপুর, কালিয়াগঞ্জ ও  ডালখোলা।)বিধানসভার আসন সাতটি লোকসভার আসন একটি( রায়গঞ্জ )।[2011সালের তথ্য]


শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ-প্রাথমিক বিদ্যালয় 1459টি, উচ্চ প্রাথমিক 78টি ,মাধ্যমিক  63 টি,  উচ্চমাধ্যমিক 61 টি,স্নাতক স্তরের কলেজ 6টি ,মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র একটি, শিশু শিক্ষা কেন্দ্র 1065টি, আইসিডিএস কেন্দ্র 158 টি ।(2011 সালের তথ্য)


ভাষা :-এই জেলার অধিকাংশের  মাতৃভাষা বাংলা,  দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মাতৃভাষা হল রাজবংশী বা কামরূপী, এছাড়াও উর্দু ও সাঁওতালি ।পালিয়া, দেশিয়া, কোচ ও রাজবংশী জাতির মানুষ নিয়ে রাজবংশী সমাজ সংখ্যাগরিষ্ঠ। 


উৎসব :-রাজবংশী সমাজের "ক্ষণগান","নটুয়া গান",  "বোলভাইগান" এবং মুসলমান সমাজের বিভিন্ন পীরের মেলায় প্রচুর মানুষ যোগদান করে। 


পর্যটন :-উত্তর দিনাজপুরের সদর দপ্তর রায়গঞ্জের কাছে কুলিক নদীর কোলে ফরেস্ট অবস্থিত। এটি একটি পাখিরালয় ।বন বিভাগের জমিতে মূলত বাগলা, নানা জাতের বক, পানকৌরি ,ফিঙে,দোয়েল , শামুকখোল প্রভৃতি দেখা যায়। , 

Post a Comment

0 Comments