মার্কসবাদের মূলসূত্রগুলি আলোচনা করো || উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান

 পড়াশোনা:-দ্বাদশ শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পঞ্চম অধ্যায়-'কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মতবাদ'- থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাছাই করা প্রশ্ন "মার্কসবাদের মূলসূত্রগুলি আলোচনা করো" দেওয়া হলো। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে প্রশ্নটি সাজানো হয়েছে। তবে প্রতি বছরের জন্য এই প্রশ্ন উত্তরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীরা খুজে চলেছে - ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল সূত্রগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করো , ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল সূত্রগুলি আলোচনা করো, মার্কের রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্ব আলোচনা করো, মার্কসবাদের বৈশিষ্ট্য pdf প্রভৃতি। 

■ নির্দিষ্ট সূচীতেই পরীক্ষা হবে আগেই জানিয়ে ছিলাম। দুদিন পরেই দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা শুরু হবে। তাই তোমাদের কথা ভেবেই আজকে এই গুরুত্বপূর্ণ রচণাধর্মী প্রশ্নটি দেওয়া হলো। যেহেতু প্রশ্নের মান 8 তাই মাত্র ছয়টি পয়েন্ট দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নের উত্তরের PDF দেওয়া হলো। বার্ষিক পরীক্ষায় 99% সম্ভাবনা আসার। 

বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান 
অধ্যায় পঞ্চম অধ্যায়ঃ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ
 রাজনৈতিক মতবাদ । 
প্রশ্নের ধরণরচণাধর্মী ।
প্রশ্ন সংখ্যা  একটি। 
প্রশ্নের মান  ৮ 


মার্কসবাদের মূল সূত্রগুলি আলোচনা কর। 


Ans : ভূমিকা : মার্কসবাদ কী ? এ প্রসঙ্গে এমিল বার্নস বলেছেন, মার্কসবাদ হল আমাদের এই জগৎ এবং তারই অংশ মানব সমাজ সম্পর্কে সাধারণ তত্ব। কার্লমার্কসের নাম অনুযায়ী এই তত্বের নামকরণ করা হয়েছে মার্কসবাদ। আবার ল্যালিনের মতে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষাসূচিকেই মার্কসবাদ বলে। 

মার্কসবাদের মূল সূত্র : মার্কসবাদের মূল সূত্রগুলি হল - ১.দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, ২.ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, ৩.উদ্বৃত্ত্বমূলক তত্ব, ৪.শ্রেণী সংগ্রামের তত্ব, ৫.রাষ্ট্র সংক্রান্ত তত্ব ও ৬. বিপ্লব সংক্রান্ত তত্ব। 

১. দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ : এই নীতি অনুযায়ী বলা হয়েছে জগতের প্রতিটি বস্তু পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং এই বস্তুজগৎ সর্বদা পরিবর্তনশীল। জগতের প্রতিটি বস্তুরই নিজস্ব ধৰ্ম ও বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। সেগুলি হল বাদ , প্রতিবাদ এবং সমবাদ। তাই প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় এবং সমাজের পরিবর্তন ঘটে। যেমন-পুজিপতি মালিক ও শ্রমিকশ্রেণীর বিরোধের ফলেই সমাজের পরিবর্তন ঘটে। এই তত্ত্বকেই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলে। 

২.ঐতিহাসিক বস্তুবাদ : মার্কসবাদের অন্যতম উপাদান হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এই তত্ব শুধুমাত্র সমাজ ও বিভিন্ন সংগঠনের বিকাশের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করে না , এই তত্ব ভবিষ্যৎ সমাজ ব্যবস্থা কেমন হবে সে সম্পর্কেও চিন্তা ভাবনা করে। এই তত্বের মূল বক্তব্য হল - ক) সমাজ ব্যবস্থার ইতিহাসে আজ পর্যন্ত দেখা গেছে শ্রেণী সংগ্রাম। এই সংগ্রামের মূল কারণ হল শোষক ও শোষিতের অর্থনৈতিক স্বার্থ। এই অর্থনীতি দাড়িয়ে থাকে উপাদান ব্যবস্থার উপর। এই উপাদান ব্যবস্থার  দুটি দিক , যথা - উপপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন শক্তি। 
   খ) উৎপাদন ব্যবস্থার দুটি অংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিবাদ দেখা দিলেই সমাজের পরিবর্তন হয়। যেমন অতীতে উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল না। তাই শ্রেণী সংগ্রামও ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে মালিক ও শ্রমিক উৎপাদনের উপর নির্ভর হওয়ায় বিপ্লব বা বিদ্রোহ দেখা গেছে। 

৩.উদবৃত্তমূল্যের তত্ব : মার্কসবাদের এই তত্ব অনুযায়ী বলা হয়েছে শ্রমিকরা শ্রম বিক্রি করে যা উৎপাদন করে সেই মূল্যের সামান্য অংশ মজুরি হিসেবে পায়। আর বাকি সে মূল্য দেওয়া হয় না , তাকেই উদবৃত্তমূল্য বলে। যেমন- একজন শ্রমিক  কাজ করে পাঁচহাজার টাকার ইট তৈরী করলে এবং মজুরি পেলো পাঁচশো টাকা তবে দ্রব্যটির উদবৃত্তমূল্য হল ( ৫০০০- ৫০০ = ৪৫০০)। 

৪.শ্রেণী সংগ্রাম তত্ব :  কার্লমার্কসের শ্রেণী সংগ্রাম তত্বের মূল কথা হল আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত সমাজ দেখা গেছে, তার প্রত্যেকটিতেই মালিক ও শ্রমিক এই দুটি শ্রেণীর মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শগত সংগ্রাম চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পুজিপাতি শ্রেণীর সর্বনাশ ঘটে এবং সর্বহারা শ্রেণীর ক্ষমতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়।  

৫.রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ব : মার্কসের মতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সমাজের শুরুতে হয়নি সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে শোষক ও শোষিত এই দুই শ্রেণীতে সমাজ বিভক্ত হয়ে পরে। সম্পত্তির মালিকানার নিরাপত্তার  জন্য যে বল প্রয়োগের হাতিয়ারের প্রয়োজন তা হল রাষ্ট্র যদি কেউ এই রাষ্ট্রকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তবে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে। তারপর শ্রেণীহীন,শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। 

৬.বিপ্লব সংক্রান্ত তত্ব :  এককথায় বিপ্লবের অর্থ হল পরিবর্তন যা পুরোনো সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নতুন সমাজ গড়ে তুলে। ল্যালিনের মতে বিপ্লব হিংসার তাণ্ডব নয় , বিপ্লব হল উৎপীড়ণ ও শোষণের মহাউৎসব।  

মন্তব্য : পরিশেষে বলা যায় যে বহু রাষ্ট্র বিজ্ঞানী মার্কসবাদের সমালোচনা করলেও দরিদ্র , দুঃখী , মেহপতি মানুষের দুঃখের হাত থেকে মুক্তির উপায় হল মার্কসবাদ। তাই মার্কসবাদকে বিশ্ববীক্ষা বলা যেতে  পারে। 

কার্লমার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্বটি আলোচনা কর। 


Ans : ঐতিহাসিক বস্তুবাদ : পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যতজন সমাজতান্ত্রিক জন্ম হয়েছে তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন কার্লমার্কস। তার রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মৌলিক উপাদান হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এই সাধারণ তত্ব বস্তুবাদী ব্যাখ্যা নামেও পরিচিত। এই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রধান উপাদান হল তিনটি। যথা - ১.সমাজের পরিবর্তন ও বিকাশ প্রকৃতির মতোই সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক নিয়মের অধীন , ২.রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ,সংস্কৃতি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয় বিষয়গত জীবনযাত্রার বিকাশের ভিত্তিতে , ৩.বৈষয়িক জীবনযাত্রার পদ্ধতি কর্তৃক সৃষ্ট মতবাদ ও প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। 

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সংজ্ঞা : ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলতে বোঝায় মানব সমাজ ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগের ব্যাখ্যাকে। স্টালিনের ভাষায় - "Historical materialism in the extension of principals of dialectical materialism to the study of social life ."। 

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল বক্তব্য :ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন কার্লমার্কস তার কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো গ্রন্থে। তারমতে ইতিহাস শুধুমাত্র কতকগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনার সংকলন নয় । ইতিহাসে প্রত্যেকটি ঘটনা অন্য ঘটনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তাই ইতিহাস কোনো একজন রাজা বা রানীর কথা তুলে  না। সমগ্র জনসাধারণের কথা তুলে ধরে। এই মতবাদের অন্যান্য বক্তব্যগুলি হল -

১.পরিকাঠামো : মার্কসবাদ অনুযায়ী অর্থনীতি হল সমাজের মূল ভীত। এর ওপর দাড়িয়ে থাকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা , আইনব্যবস্থা , ধৰ্ম , সাহিত্য প্রভৃতি। তাই অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটলে উপরি  পরিকাঠামোর পরিবর্তন আসবে। 

২.মানুষের প্রাথমিক চাহিদা : কার্লমার্কসের মতে মানুষের মৌলিক চাহিদা হল খাদ্য , বস্ত্র ও বাসস্থান। বাঁচার জন্যই মানুষ উৎপাদনে অংশগ্রহন করে এবং উৎপাদন নির্ভর করে উপায় ও পদ্ধতির উপর। সুতরাং বলা যায় উৎপাদন পদ্ধতি হল সবকিছুর প্রধান চাহিদা শক্তি। 

৩.উৎপাদন পদ্ধতির শ্রেণী : উৎপাদন পদ্ধতির দুটি দিক ,যথা - ১.উৎপাদন শক্তি , ২.উৎপাদন সম্পর্কে শ্রমিক ও তার দক্ষতা এবং প্ৰয়োজনয়ীয় যন্ত্রপাতিকে বলা হয় উৎপাদন শক্তি।  তাই উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকের সঙ্গে মালিকের এবং শ্রমিক যে যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদন করে তার প্রতি শ্রমিকের ভালোবাসা গড়ে উঠলে উৎপাদন সম্পর্ক মজবুত হয়। 

৪.ভারসাম্য : কার্লমার্কস বলেছেন উৎপাদন পদ্ধতি পরিবর্তিত হলে উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটবে। অর্থাৎ উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকলেই আদর্শ সমাজ গড়ে উঠবে। 

৫.সমাজের পরিবর্তন : ঐতিহাসিক তত্ব অনুযায়ী বলা হয়েছে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ঝগড়া বা বিবাদ ঘটলেই সমাজের পরিবর্তন ঘটে।  যেমন -শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলেই বিপ্লব ঘটে এবং শোষণহীন সমাজ গড়ে উঠে। 

৬.ইতিহাসের গতিবিধি : প্রাচীন সাম্যবাদী সমাজে উৎপাদন শক্তি ও সম্পর্কের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না।  কিন্তু পরবর্তীতে দাস সমাজে প্রভুরা শ্রমিকদের উপর অত্যাচার করলে শুরু হয় শ্রেণী সংগ্রাম। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয় নতুন সমাজব্যবস্থা। 

সমালোচনা : অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্লমার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের  সমালোচনা করেছেন। যেমন -১. জানিয়েল বেল, রেমন্ট-অ্যারো প্রমুখেরা বলেছেন শ্রেণী সংগ্রামের দ্বারা ইতিহাসের অগ্রগতি ঘটেনি। প্রযুক্তি বিদ্যার সাহায্যে সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে। ২.গডর্ন বলেছেন উৎপাদন শক্তি উৎপাদন সম্পর্কে এবং অপরের পরিপূরক। ৩. পপার ,মের্লো বলেছেন সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে কোনো ঐতিহাসিক নিয়ম প্রয়োগ করা যায় না।  

Post a Comment

0 Comments